রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫, ০৩:১২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
শিরোনাম :
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাকে ‘ভয়াবহ’ বললেন স্টারমার ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরামের ৪৫২ তম সাহিত্য আড্ডা অনুষ্ঠিত শার্শায় পূর্ব শত্রুতার জেরে কুপিয়ে হত্যা: নিহত লিটন হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের নবীন বরন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত। পোরশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক থাকার কথা কমপক্ষে ১০ জন, পরিতাপের বিষয় আছে মাত্র ০৩ জন। মানবিক বেওয়ারিশ ফাউন্ডেশনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সিমকী ইমাম খানের উক্তি করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট: আগের থেকে কতটা ভিন্ন পাকা আমের ভাপা দইয়ের রেসিপি তীব্র গরমে সুস্থ থাকতে খেতে পারেন যেসব সালাদ
Notice :
"Jonotarmotamot"  (জনতার মতামত) বা গণমানুষের সম্মিলিত ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাস। কোন নির্দিষ্ট বিষয়, ঘটনা বা নীতি সম্পর্কে সমাজের একটি বৃহৎ অংশের মানুষের সমষ্টিগত চিন্তা বা অনুভূতি।

আমরা কেন ‘চেষ্টা’ করি, বিকল্প কী

প্রতিনিধির নাম: / ৩ ভিউ:
আপডেট সময়: বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫, ৭:৪৩ অপরাহ্ন

হাইনরিখ চার্লস বুকোস্কি (১৯২০-১৯৯৪) একজন জার্মান-মার্কিন লেখক। মার্কিন সমাজের নিপীড়িত মানুষের কাহিনি লিখতে গিয়ে তিনি নগর জীবনের অবক্ষয়কে তুলে ধরেছিলেন। মৃত্যুর পর বুকোস্কিকে লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধিস্তম্ভে তার নামের নিচে লেখা রয়েছে ‘ডোন্ট ট্রাই’, অর্থাৎ ‘চেষ্টা করো না।’ এ হচ্ছে জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বুকোস্কির দর্শন। কিন্তু এর মানেটা আসলে কী?

বুকোস্কিকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কীভাবে লেখেন? উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন তা অনেকটা তরুণ লেখকদের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত খ্যাতিমানের পরামর্শ বলা চলে। তিনি বলেছিলেন, ‘চেষ্টা করো না। চেষ্টা না করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচুর্য, শিল্প অথবা অমরত্বের জন্য চেষ্টা করো না। অপেক্ষা করো। যদি কিছু না ঘটে, তাহলে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করো। দেয়ালের অনেক ওপরে বসে থাকা একটা পোকার নাগাল পেতে চাইছো তুমি? অপেক্ষা করো। নাগালে এলে হাত বাড়াও। তারপর মেরে ফেলো, অথবা পোষ মানাও।’

এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে বুকোস্কি একবার লিখেছিলেন, ‘আমরা প্রাণান্ত পরিশ্রম করি। অর্জনের জন‍্য আমরা অনেক বেশি চেষ্টা করি। কিন্তু শুধু চেষ্টা করেই সফল হওয়া যায় না। তাই চেষ্টা করো না। সফলতার মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে এখানেই। সেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অবরুদ্ধ এক গর্ভ থেকে বের হয়ে আসার জন্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমরা সাফল্যের অনেক নির্দেশনা পেয়েছি। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। আসলে পুরো ব‍্যাপারটাই উন্মুক্ত। এ প্রসঙ্গে বলার কিছু নাই।’

ব্যাপারটা আরও সহজ করা যাক। পাকা কাঁঠাল খেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকালে সেটি খেতে সুস্বাদু হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মে সেই ঘটনা ঘটতে দিতে হবে। ফলপ্রসূ জীবনযাপন, দুর্দান্ত শিল্পকর্ম অথবা অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার জন‍্য মেধার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ প্রয়োজন। অতিরিক্ত চিন্তা আর বিশ্লেষণ অথবা ক্রমাগত লড়াই আর কুস্তি করে মহৎ কাজ করা যায় না। পরিণত বয়সে বুকোস্কির জীবনে এই উপলব্ধি আসে। তার এই প্রগাঢ় উপলব্ধির সঙ্গে প্রাচীন ‘তাও’ দর্শনের মিল রয়েছে। এর নিগূঢ় অর্থ বোঝার জন্য ‘প্রচেষ্টার’ কর্মকৌশল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।

আমরা সবাই সফল হতে চাই। কিন্তু শুধু চেষ্টা করে সফল হওয়া যায় না। এ জন্য মেধা, যোগ‍্যতা, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এমনকি ভাগ্যের সহযোগিতাও প্রয়োজন হয়। চেষ্টা হলো জোর করা। স্বার্থভাবনা মানুষকে চেষ্টা করতে উদ্বুদ্ধ করে। যেখানে স্বার্থভাবনা থাকে, সেখানে ভালোবাসা থাকে না। তাই চেষ্টা করে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত। চেষ্টা করে বেঁচে থাকা যায় না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ‍ করা প্রয়োজন, নতুন কোনো বিষয় যেমন, ভাষা অথবা গণিত শিক্ষার জন্য চেষ্টা প্রয়োজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, দৈনন্দিন জীবনের কাজ সম্পাদনের জন্য চেষ্টা প্রয়োজন। বস্তুজগতে ভৌত পরিবর্তন আনার জন্যও চেষ্টার প্রয়োজন আছে। কিন্তু মনোজাগতিক অবস্থার কথা ভিন্ন। তাহলে প্রাণান্ত প্রয়াস বা প্রচেষ্টার অর্থ কী?

ইচ্ছা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিয়োজিত কর্ম হলো প্রচেষ্টা। মানুষের জীবন প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল। ইচ্ছাশক্তি ছাড়া আমরা কোনো কর্ম কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং তথাকথিত আধ্যাত্মিক জীবন হলো প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা। এটি সর্বদা নির্দিষ্ট ফলাফল প্রসব করবে বলে ধারণা করা হয়। সবসময় আমরা একটা কিছু হতে চাইছি। আর তা হবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করি। লক্ষ‍্য অর্জন করে ফল লাভের জন্য আমরা প্রাণান্ত প্রয়াস চালাই। এই প্রয়াসের অন্তরালে কাজ করে মানুষের ইচ্ছা। ইচ্ছা হলো ভাবনা। মানুষের অন্তর্জগতে অবিরাম ভাবনা জন্ম নেয়। এই ভাবনা স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষকে ইন্ধন যোগায়। ভাবনার অনলে পুড়তে পুড়তে মানুষ অভিষ্ঠ লক্ষ‍্য অর্জনের তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু সংগ্রাম করে সুখী হওয়া যায় না।

আমাদের মনোজাগতিক অবস্থা হলো, ‘যা আছে’ তা নিয়ে আমরা সুখী নই। ‘যা আছে’ সেদিকে আমরা তাকাতে চাই না। তা থেকে পালাতে চাই। অথবা ‘যা আছে’ তা কীভাবে বদলানো যায় বা রূপান্তরিত করা যায় সেই ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকি। কারণ ‘যা নেই’ তা পাবার উদগ্র বাসনা আমাদের তাড়িয়ে ফেরে। ফলে ‘যা নেই’ তা আমরা জীবনে পেতে চাই। ‘যা নেই’ তা পাবার জন্য সংগ্রাম করি। এই সংগ্রাম প্রয়াস বা চেষ্টা হিসেবে প্রকাশ পায়। তাই প্রয়াস হলো আমাদের ‘যা নেই’ তা পাবার মনোজাগতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রাম ‘যা আছে’ তা থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়। কিন্তু পরিতৃপ্ত হতে হলে আমাদের ‘যা আছে’ সেদিকে তাকাতে হবে। ‘যা আছে’ তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারলে সংগ্রাম স্তিমিত হয়। তখন অন্তরে শান্তি ফিরে আসে। তাই ‘যা আছে’ তা বুঝতে পারার মধ্যেই পরিতৃপ্তি লুকিয়ে আছে।

মানুষ প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের পরিপূর্ণতা বিধানের প্রয়াস চালায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আমি কদাকার কিন্তু আমি সুশ্রী হতে চাই। আমি যা নই আমি সেটাই হতে চাইছি। এই হতে চাওয়ার মধ্যে আমরা পরিপূর্ণতা খুঁজছি। সেটা হবার জন্য আমি সংগ্রাম করছি। যুদ্ধ করছি। অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছি। পরিপূর্ণতা অর্জন করা প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য বা চালিকাশক্তি। আমরা কোনো ব্যক্তি অথবা বস্তুর ধারণার মধ্যে পরিপূর্ণতা খুঁজছি।

এখন প্রশ্ন হলো নিজেকে পরিপূর্ণ করার আকাঙ্ক্ষা কেন আমাদের তাড়িয়ে ফিরছে? কারণ আমাদের অস্তিত্বের গভীরে শূন‍্যতা বিরাজ করছে। শূন‍্যতা হলো অস্তিত্বহীনতা। মানুষ সাধারণত একটা কিছুর অভাব হিসেবে এটা তাদের জীবনে অনুভব করে। অদ্ভুত এক অভাববোধের অনুভূতি বয়ে বেড়ায়। কি যেন একটা নেই আমার জীবনে! অন্তর্গত দৈনতার এই অনুভূতিকে অতিক্রম করার এক তীব্র তাগিদ সে অনুভব করে। একটা কিছু দিয়ে তার অন্তরের শূন্যতা পূরণের জন্য মানুষ হন্যে হয়ে ওঠে। কারণ আমি শূন্য। আমি কিছুই না। এই অপর্যাপ্ততার অনুভূতি, আভ্যন্তরীণ এই দৈন্যতা আমরা সহ্য করতে পারি না। এ থেকে আমরা পালাতে চাই। অন্তর্গত এই দৈন্যতা পূরণের জন্য আমরা সর্বদা কিছু হওয়ার চেষ্টা করি। একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের মধ্যে অথবা একটি বস্তু বা ধারণার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ‘আমি’ নিজেকে পরিপূর্ণ করার জন্য হন্যে হয়ে সংগ্রাম করতে থাকে। অন্তরের শূন্যতা থেকে মুক্ত হওয়ার এই উদ্যোগ ভাবনা, কর্ম ও অর্জনের নিরন্তর সংগ্রাম হিসেবে মানুষের জীবনে প্রকাশ পায়।

আমাদের ‘যা আছে’ তার অন্তরালে লুকিয়ে আছে শূন্যতা। আর তা থেকে পালানোর জন্য যখন আমরা কোনো কাজ করি, তখন সেটা আসলে ‘ক্রিয়া’ হয় না, সেটা হয় ‘প্রতিক্রিয়া’। আর প্রতিক্রিয়া হলো ‘যা আছে’ তা এড়িয়ে যাওয়া অথবা অস্বীকার করা। অথচ আমাদের ‘যা আছে’ তা উপলব্ধির মাঝেই সৃজনশীলতা লুকিয়ে আছে। তাই আমরা যদি অন্তরের এই শূন‍্যতা থেকে পালানোর চেষ্টা না করি তাহলে তা অন্তরকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করতে পারে। অন্তরের এই প্রগাঢ় একাকীত্ব ও শূন‍্যতাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলে তা থেকে পালিয়ে বাঁচার প্রয়াস থাকে না। ফলে মনের অন্তরালে চলতে থাকা সংগ্রাম স্তিমিত হয়। প্রচেষ্টা বা প্রয়াস তখনই থাকে, যখন অস্তিত্বের গভীরে বিরাজমান শূন্যতা ও একাকীত্বকে এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এড়িয়ে না গিয়ে যখন আমরা এটিকে পর্যবেক্ষণ করি এবং পরিহারের বদলে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করি তখন সমস্ত সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে। তখন আমরা নিজেদের স্বমহিমায় প্রকাশের সুযোগ করে দেই। তখন সৃষ্টিশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে।

পরিণত বয়সে অজ্ঞাতসারে হয়তো বুকোস্কি এই চরম উপলব্ধিতেই পৌঁছান। তাই সমাধিস্তম্ভে তার নামের নিচে লেখা রয়েছে ‘ডোন্ট ট্রাই’।

লেখক: আসিফ হাসান চৌধুরী, পিএইচডি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর