সানজানা রহমান যুথী..
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি-সুকান্ত ভট্টাচার্যের পঙ্ক্তিটি যেন যুগ যুগ ধরে সত্য প্রমাণিত হয়ে আসছে। শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য মানুষ যে কোনো কাজ করতে পারে। জগতের সব মানবিকতা যেন দারিদ্র্যতার কাছে হার মানে। শিশুশ্রম যেন তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যে বয়সে একটি শিশুর খেলাধুলা করার কথা, সেই বয়সেই সে খেলার মাঠের পরিবর্তে থাকে কারখানায়। যেই হাতে কলম দিয়ে লেখার কথা, সেই হাত দিয়েই করে নিজের ওজনের চেয়ে ভারী কাজ। পরিবারের সব দ্বায় দ্বায়িত্ব যেন ছোট হাত দুটোর ওপরই পরে। তারাও সুকান্ত ভট্টাচার্যের পূর্ণিমার চাঁদের মতো কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে মেটাতে নিজেরা কখন ঝলসে গেছে, তা বুঝতে পারে না।
শিশুশ্রম আমাদের যত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক অকল্পনীয় অভিশাপ। দরিদ্র বাবা মা যখন আর্থিকভাবে চলতে পারেন না তখন দুবেলা ভালো খাওয়ার আশায় ছোট ছোট নাবালক ছেলে মেয়েদের কাজে লাগিয়ে দেন। তাদের কাছে পড়াশোনা যেন এক বিলাসিতা। কারণ যেখানে পেটের ক্ষুদাই মেটে না সেখানে পড়াশোনাটা বিলাসিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও চালায় কারখানা মালিকরা। তারা ছোট তাই মুখ বুঝে এসব সহ্যও করে, আবার পরিবারের কাছে বলতেও সাহস পায় না। মাঝে মাঝে আমাদের সমাজে এমন চিত্রও দেখা যায় দরিদ্র বাবা -মাও ছোট ছোট সন্তানদের খাবারের জন্য কথা শোনায়। যা একটি শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে বাধাগ্ৰস্ত করে।
আইন কি বলে?
১. বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না বা তাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। তবে কিশোর হলে শর্ত সাপেক্ষে কাজের অনুমতি দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে সরকার চাইলে যেকোন মুহূর্তে কিশোর নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে পারবে। এই আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী, কোনো অভিভাবক শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি দিয়ে চুক্তি করতে পারবে না, করলেও সেটি অবৈধ চুক্তি বলে বিবেচিত হবে। যদি কোনো ব্যক্তি ৩৪ ধারা অমান্য করে শিশু বা কিশোরকে নিয়োগ দিলে বা অনুমতি দিলে ঐ ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা এবং ৩৫ ধারার বিধান লঙ্ঘনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের দন্ডিত করা যাবে।
২. বাংলাদেশ শ্রম আইন,২০০৬ এর ৩৯ ও ৪০ ধারা অনুযায়ী, সরকার কর্তৃক ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কিশোর নিয়োগ করা যাবে না অর্থাৎ কোনো চলমান যন্ত্র পরিষ্কার করা বা তেল প্রদান বা অন্য কোন কাজে নিযুক্ত করা যাবে না তবে ৪০ ধারা অনুযায়ী, কোন কিশোরকে কোনো যন্ত্র সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং সম্ভাব্য বিপদ ও সতর্কতা সম্পর্কে জানিয়ে কাজ করার অনুমতি দেওয়া যাবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব আইন থাকলেও কোনটির তেমন প্রয়োগ ও প্রচলন নেই। সহজ কথায় বলতে গেলে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। অনেক সময় দেখা যায় ঘুষ দিয়ে কারখানা মালিক এসব ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে ভুক্তভোগী ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও টাকার জন্য তেমন প্রতিক্রিয়াও দেখায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা-মারাই ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ বানিয়ে সন্তানদের কাজে ঢুকিয়ে দেন।
শিশুশ্রম দমনে করণীয়
১. সরকারের উচিত বিদ্যমান শ্রম আইন ও শিশু আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা পাশাপাশি শিশু নিয়োগের দায়ে নিয়োগদাতাকে জরিমানা ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ ও তাদের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
২. শিশুদের শ্রমে না ঠেলে, তাদের পরিবারের আয়ের বিকল্প উৎস সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারকে ক্ষুদ্র ঋণ, ভাতা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা।
৩. গ্রামে ও শহরে শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো। এছাড়াও গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সচেতনতায় যুক্ত করা।
৪. শিশুশ্রম থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা।
৫. সবশেষ শিশু ও অভিভাবকদের মধ্যে নৈতিকতা ও শিশুর অধিকার সম্পর্কে অবহিত করা।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। একটি দেশ কখনোই উন্নতি করতে পারে না যখন সে দেশের একটি বৃহৎ অংশই শিশুশ্রম আবদ্ধ। যদি শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা যায় তবেই আমরা আগামীর সুন্দরতম বাংলাদেশ দেখতে পাবো। যেখানে সবাই সমান অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে। যেখানে পূর্ণিমার চাঁদের মতন সুন্দর শিশুরা তাদের নরম হাতে ভারী বোঝা তুলবে না।
lssrma